পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্তে নির্দোষ ব্যক্তিই প্রধান আসামি!
কক্সবাজার সদরের পিএমখালীতে সরকারি পাহাড় কেটে মাটি ও বালু বিক্রির অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তরের করা মামলা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনে যিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, পরে তাকেই প্রধান আসামি করা হয়েছে। ২৪ অক্টোবর কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলাটি করেন অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম। যদিও প্রধান আসামি ওবাইদুল করিম ওই এলাকার বাসিন্দা নন। তাছাড়া তার পক্ষে এই এলাকায় এসে পাহাড় কাটাও সম্ভব নয়। মামলায় ওবাইদুল করিমসহ ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, পিএমখালীতে সরকারি পাহাড় কেটে বালু ব্যবসা নিয়ে ৬ আগস্ট বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৮ আগস্ট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পরিবেশ ও বন বিভাগের একটি যৌথ দল। তারা পিএমখালীর ছনখোলা এলাকার তাজমহলের ঘোনা, ঘোনারপাড়া, তেইল্যাকাটা, পশ্চিমপাড়া নামক স্থানে পাহাড় কাটার দৃশ্য দেখতে পান। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে যাদের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে ওবাইদুল করিমের নাম নেই। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর তাকেই প্রধান আসামি করে কক্সবাজার মডেল থানায় মামলা করেছে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন-সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের সদস্য মাহমুদুল করিম মাদু এবং নয়াপাড়ার বাসিন্দা ও পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদের, জেলা পরিষদের সদস্য মাদুর বড় ভাই মামুন; ছনখোলার জাহাঙ্গীর আলম; তোতকখালীর জোসেফ, সাবেক ইউপি সদস্য তাজমহল ও কায়েস সিকদার; দক্ষিণ খুনিয়াপালংয়ের নুরুল কবির বাবুল; ঘোনারপাড়ার লুৎফর রহমান ও সোনা আলী; পরানিয়াপাড়ার কাজল ও মনিরুল ইসলাম; খুরুশকুল লামাজিপাড়ার নাছির উদ্দিন; উত্তর পরানিয়াপাড়ার সোহেল; তোতকখালীর সিরাজ ও শাহজাহান; নয়াপাড়ার হারুন; ডিকপাড়ার মোস্তাক আহমদ ও নুরুল আমিনকে। থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নাজমুল হুদা বলেন, নথিভুক্ত মামলাটি তদন্ত করবেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
পাহাড় কাটার বিষয়ে তদন্তের পর পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে অভিযোগ আসা ২৩ জনের মধ্যে ওবাইদুল করিমসহ চারজন পাহাড় কাটায় জড়িত নেই বলে উল্লেখ করা হয়। স্থানীয় মেম্বার, সমাজকর্মী, সচেতন অধিবাসী, বন বিভাগের রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তার সাক্ষ্যে সিকদার গ্রুপের ১৯ জনের সম্পৃক্ততার কথা উঠে আসে। ওবাইদুলসহ বাকি চারজন বাইরের লোক হওয়ায় তারা সংশ্লিষ্ট পাহাড় কাটা, মাটি ও বালু বিক্রিতে জড়িত নেই বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাবেক মেম্বার তাজমহলের নিয়ন্ত্রণাধীন সিকদার গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাইরে কারও ডাম্পার এসে মাটি-বালু নিতে পারে না। তাই ওবাইদুল করিম ও অন্যরা পাহাড়ে যাননি।
এদিকে প্রতিবেদন জমার পর সাক্ষ্যের বিষয়টি এড়িয়ে ওবাইদুলসহ চারজনকে অভিযোগ থেকে রহস্যজনকভাবে বাদ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর পরই বাদ যাওয়া চারজনের মাঝে তিনজনকে রেখে আগের বন মামলা থাকার কথা বলে ওবাইদুল করিমকে প্রধান আসামি করে ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অথচ বাদ দেওয়া তিনজনের নামেও আদালতে চলমান একাধিক বন মামলা রয়েছে। এ কারণে মামলাটি নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
প্রধান আসামি ওবাইদুল করিম বলেন, ওই এলাকায় কার প্রতিপত্তি রয়েছে সেটা তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট। সেখানে আমার মতো নিরহ একজনের যাওয়ার ক্ষমতা নেই, তা প্রতিবেদনের বিবরণে রয়েছে। কিন্তু এর পরও কথিত পরিবেশবাদীদের মন রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর আমাকে প্রধান আসামি করেছে। ক্ষমতার চেয়ারে থাকা ব্যক্তিরা নিরহ মানুষকে চাইলেই অপরাধী বানাতে পারেন, এটা তারই উদাহরণ। আমার গাড়ি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মালামাল ও ইট পরিবহণে নিয়োজিত- সেটা তদন্ত করলে যে কেউ সত্যতা পাবেন। আমি পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত নই।
আরেক আসামি আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল করিম বলেন, কয়েক যুগ আগে থেকে আমি কক্সবাজার শহরে থাকি। এলাকায় না থাকা সত্ত্বেও ওই এলাকায় বাবার বাড়ি হওয়ায় সামাজিকভাবে হেয় করতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ইন্ধনে পরিবেশ অধিদপ্তর আমাকে আসামি করেছে। বিষয়টি আইনগতভাবে মোকাবিলা করব।
জানতে চাইলে মামলার বাদী সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম মামলার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর তদন্তে নির্দোষ ও এলাকার বাইরে থাকা লোকজনকে কেন আসামি করা হলো এমন প্রশ্ন শুনে উত্তর না দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কল করতে বলে লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। এরপর আর তাকে পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, একটি সংঘবদ্ধ চক্র গত এক বছর ধরে কয়েক একর আয়তনের সরকারি একাধিক পাহাড় কাটছে। এখান থেকে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট বালু ও মাটি বিক্রি করেছে তারা। মাটি ও বালু বিক্রি করে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
পরিবেশের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, কারও প্ররোচনায় কাউকে আসামি করা হয়নি। এর পরও ঘটনায় জড়িত না থাকা প্রমাণ করতে পারলে তাদের বাদ দেওয়া হবে।